Wednesday 21 November 2018

উকুন (অণুগল্প), বরুণ কুমার সাহা, গুয়াহাটি, ২২/১১/২০১৮





সিটিবাসে প্রচণ্ড ভিড়। গাড়ির ঝাঁকুনিতে খুব সহজেই ঘষা খাচ্ছে মানুষের মাথা, পিঠ, হাত, উরু, বুক, পাছা, ঠ্যাং, বিবেক, বুদ্ধি, হরমোন।

একটি বুদ্ধিমান উকুন এক বিধবা তরুণীর লম্বা চুল বেয়ে বেয়ে নেমে আসছে। আসলে সে আগেই অশনিসংকেতের গন্ধ পেয়েছিল।
প্রায়ই এই মেয়েটিকে পাগলের মতো রাত জাগতে দেখেছে সে। চুলগুলি সামনের দিকে ছেড়ে দিয়ে একলা একলা আয়নার সামনে হাসতে দেখেছে, নিজের হাত-পা নিজেই কামড়াতে দেখেছে অনেকবার।

বুদ্ধিমান উকুনটি মহল্লার সব উকুনকে বিষয়টি অবগত করেছিল, কিন্তু কেউ পাত্তা দেয়নি । ওদের মতে, তরুণীটি ভারি লোভনীয়! খাসা মাল। ঘিলু ভর্তি মাথায় গরম গরম রক্ত । তাছাড়া, নিরীহ মেয়েটি মাথাও চুলকোয় না, ভিনেগারও লাগায় না, মেডিকের শ্যাম্পুও ঘষে না, এমনকি দুই নখে কাউকে পিষেও মারে না। তাই এই এলাকা ছেড়ে দেওয়া উকুন-সভ্যতার পরিপন্থী।
বুদ্ধিমান উকুনটি ওর জ্ঞাতিগুষ্টির রক্ষণশীলতা দেখে হতাশ হয়। অবশেষে একলা চলার দীক্ষা নিয়ে দেশের বাড়ির মায়া ত্যাগ করে।

উকুনটি ইতিমধ্যে অনেকবার চেষ্টা করেছিল মাথান্তর হওয়ার। কিন্তু মাথা কোথায়? প্রব্রজন কি অতই সহজ? পা ফোঁসকে গেলে কোথায় গিয়ে পড়বে তার ঠিক নেই। পদে পদে লুকিয়ে থাকে মৃত্যু, নখের আতঙ্ক। কিন্তু পরিস্থিতি যা! যে-করেই হোক ভিটেমাটি তো ছাড়তেই হবে।
কাল রাত থেকেই মেয়েটিকে সে লক্ষ করে চলেছে। কেমন যেন ভৌতিক ভৌতিক মনে হচ্ছিল তাকে। একবার হাসে, একবার কাঁদে, একবার নখ কামড়ায়, একবার চুল টানে, একবার দেয়ালে মাথা ঠোকে। তারপর সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে যায় অজানা ঠিকানায়। ফিরবার পথে সে সংগ্রহ করে একটা লম্বা দড়ি। হ্যাঁ, কাঁধের এই কালো ব্যাগটিতেই সে সযত্নে ভরিয়েছে সেটা।
প্রচণ্ড ভিড়ে ভারাক্রান্ত সিটিবাস এগিয়ে চলে ।

উকুনটি ধীরে ধীরে চুল থেকে বেরিয়ে ব্যাগটির ফিতার ওপর উঠে দাঁড়ায়। ঝুলন্ত অবস্থাতেই সে লাফ দিতে চায় পাশেই দাঁড়ানো প্রৌঢ় লোকটির ঘাড়ে। কিন্তু পারে না। বাসে যতই ঠেলাঠেলি হোক, সে তো আর জাদু জানে না, আর তা ছাড়া সে জিম্নাস্টও নয় । সে একটা সাধারণ উকুন মাত্র।   
বুদ্ধিমান উকুনটি প্রাণের ঝুঁকি না নিয়ে অবশেষে দু-পা পিছিয়ে আসে। তারপর গলার পাশ দিয়ে নামতে নামতে মেয়েটির ঠিক বুকের উপর চড়ে বসে।  স্তনের শৃঙ্গের ওপর দাঁড়িয়ে সে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাকায়। সে জানে, ওকে আর ঝাঁপ দিতে হবে না। এই প্রচণ্ড ভিড়ে কারো-না-কারো কনুই এসে ঠেকবেই সেখানে।

Wednesday 10 October 2018

সময়, গুয়াহাটি, ১৮/০৯/২০১৮




রামবাবু যখন ঘড়ির দোকানের শাটার বন্ধ করে বাড়ি ফেরেন, তখন সমস্ত ঘড়িগুলো কাঁচের বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে। তারপর সময়টাকে আটকানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে।
 
সারা রাত ধস্তাধস্তির পর আবার সুড়সুড় করে কাঁচের বাক্সে ঢুকে পড়ে ঘড়িগুলো।

রামবাবু ঘুমিয়ে পড়লে ভাগ্যশ্রী আস্তে করে মোবাইলটা অন করে নিজের ফেক একাউন্টটা খোলেন। সেখানে তিনি স্কুলের প্রৌঢ় দিদিমণি নন। তন্বী। বয়স কুড়ি। রাতজাগা পাখি ।
 
তারপর ভোর হওয়ার আগে আগে মোবাইলটা বালিশ-চাপা দিয়ে সুড়সুড় করে ঢুকে পড়েন মশারির ভিতর।


কোলবালিশ, গুয়াহাটি, ১৬/০৯/২০১৮



আয় আয় চাঁদমামা টি দিয়ে যা, চাঁদের কপালে চাঁদ টি দিয়ে যা’ – গেয়ে গেয়ে গৌরীদেবী শূন্য থেকে কি যেন একটা পেড়ে কোলবালিশের মাথায় ছুঁয়ে দিচ্ছেন। কোলবালিশটির ভারি মজা লেগেছে। 
সে ঠিক করেছে, দাদাবাবুর সঙ্গে আর শোবে না কক্খনো । খুব শ্বাসকষ্ট হয়। দাদাবাবু রাতভর ঠ্যাঙের মাঝখানে নিয়ে শুধুশুধু তাকে চেপে ধরেন।

যমালয়ে অঘটন, গুয়াহাটি, 09/10/2018



এতদিন যমালয়ে সব জমজমাটই ছিল | কিন্তু অঘটনটা ঘটেই গেল | যমরাজ আত্মহত্যা করলেন | চিত্রগুপ্তর মতে, বেশ কিছুদিন ধরে তিনি ভিতরে ভিতরে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন | আবোলতাবোল বকতেন সারাক্ষণ | তাঁর সিস্টেম নাকি বিগড়ে গেছে |
সুইসাইট নোটে তিনি শুধু লিখে গেছেন, 'যাদের সময়ের কোটা ফিলাপ হয়ে গেছে, তারা দিব্বি বোনাস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে | আর যাদের টপকানোর কথাই ছিল না, তারা বেকার বেকার ভিড় করছে যমালয়ে| এভাবে চলবে না, চলতে পারে না | আমি ধর্ম হয়ে এসব নামতে বাধ্য নই | আই কুইট |

Monday 17 September 2018

র‍্যাডক্লিফের অশান্ত আত্মা


র‍্যাডক্লিফের অশান্ত আত্মা
বরুণ কুমার সাহা
গুয়াহাটি, ০৭/০৩/২০১৭



র‍্যাডক্লিফের ঘুম নেই দেড় মাসের মধ্যে কাটতে হবে চার লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বর্গ কিলোমিটার পাল্টাতে হবে এই অদ্ভুত দেশটার নকশা এ-তো আর বাচ্চাদের কেঁচি দিয়ে কাগজ কাটা নয় কারো ঘর কাটবে, কারো খেত, কারো বাগান, কারো দোকান, কারো পুকুর, কারো ভাষা, কারো সংস্কৃতি, কারো জাত, কারো ইজ্জত, কারো ধর্ম, আবার কারো মাথা এই কাজটা ঝট্পট্করতে পারলে মাউন্টবেটেন তাকে নাকি মাথায় তুলে নাচবেন তাই, ঘুম নেই সিরিল র‍্যাডক্লিফের

নয় আগস্ট উনিশশো সাতচল্লিশ খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়লেন তিনি তারপর চান করতে গেলেন কিছুদিনের সমস্ত ক্লান্তি, অস্থিরতা, সংশয়, শঙ্কা, নির্দয়তা সব যেন ধুয়ে ফেলতে চান চান করতে করতে অনেকখন তাকিয়ে রইলেন জলের দিকে এই জলই তার কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছে নদীগুলি এক-একটি পেন্সিলের দাগ কিন্তু তবুও বঙ্গ পাঞ্জাব কাটতে অনেক হিমসিম খেতে হয়েছে তাকে লিবিয়া, ইজিপ্ত, সুদান ইত্যাদি দেশগুলির মতো স্কেল বসিয়ে সোজা ঘ্যাঁচ করে দাগ কাটার ইচ্ছে ছিল তার দেখতে ভাল লাগে কিন্তু স্কেল খোঁজার সময় কোথায়! খালি হাতেই কেটেছেন প্রভিন্স দুটোকে প্রচন্ড কেঁপেছিল হাত শঙ্কায় অনেক চেষ্টা করেও সুন্দর হল না দাগগুলো বর্ডার লাইনগুলি কেমন যেন আঁকাবাঁকা, রিখটার স্কেলের ঘিচিঘিচি দাগ কিংবা ছোটো বাচ্চাদের দাগ কাটার মতো কিন্তু হাতে-তো  সময় নেই! এসব সরকারি কাজে নাকি ইমোশনাল হলে চলে না আর তা ছাড়া র‍্যাডক্লিফের তো আর লোভ নেই নবান্নের পায়েস চেখে দেখার, শখও নেই হাত-পা ছুড়ে ভাঙড়া নাচার
গোপন ঘরটিতে তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে মুছতে র‍্যাডক্লিফ আয়নার সামনে দাঁড়ান আহ্লাদে গদগদ হয়ে যায় তার সমস্ত শরীর হাসিতে নেচে ওঠে তার উলঙ্গ বুকের সমস্ত থলথলে চর্বি
আজ আগস্টের নয়, উনিশশো সাতচল্লিশ কয়েক দিনের বিনিদ্র রজনীর দলিলে মোহর বসবে আজ জীবনের অনেক বড় স্বীকৃতি যেন তার জন্য অপেক্ষা করছে ব্রিটেনের ধবধবে দুনিয়ায় আলমারি থেকে আবার ম্যাপ দুখানা বের করে তাকান তিনি নেহেরু-জিন্না রাম-শ্যাম-যদু-মধু-আবুল-রুবুল-হাবুলেরা এরই তো অপেক্ষায় লাইন ধরেছেন, হাত কচলাচ্ছেন, দাঁত কিটমিট করছেন নেচে উঠল আবার তার বুকের চর্বিগুলি


র‍্যাডক্লিফ অনেক আগেই মারা গেছেন কিন্তু আজও নাকি তার অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায় করাচি, লাহোর, ধুবড়ি, রংপুর, সিলেট, দিনহাটা, ডাউকি, করিমগঞ্জ, নোয়াখালির মাঠ-ঘাটে  ছোটাছুটি করে সীমান্তে। আর্তনাদ করে সারাক্ষণ, কাঁটাতারের ঘাঁয়ে।