পুরাণাস্ত্র কথা (ছড়া)
শ্রীবরুণ, ২৫/০৭/২০২১
মুষ্টিবদ্ধ অস্ত্রশস্ত্র, যুদ্ধক্ষেত্র কম্পময়
শৌর্য-বীর্য রক্ষা কিংবা আত্মরক্ষা, শত্রুক্ষয়
ভল্ল, চক্র-সুদর্শন, আগ্নেয়াস্ত্র, ঢাল-কৃপাণ
তোমর, অসি, ব্রহ্ম-অস্ত্র, পট্টিশ, পাশ, ধনুর্বাণ
সর্পরজ্জুবদ্ধ শত্রু নাগপাশ বাণে ভয়-উদ্বেল
গড়ুরাস্ত্র, বৈষ্ণবাস্ত্র, পাশুপত্, সীর, শক্তিশেল
ইন্দ্র হস্তে বজ্র গর্জে, বরুণ হস্তে অম্বুবাণ
গদা হস্তে বৃকোদর-হনুমন্ত-জাম্ববান
হলস্কন্ধে বলভদ্র, পরশুরামের কুঠার্-হাত
শতঘ্নীতে সৈন্যশত ছত্রভঙ্গ ধূলিস্যাৎ
চন্দ্রহাসে অর্ধ-চন্দ্র, শক্তিশেলাস্ত্র, গাণ্ডিব
খড়্গ হস্তে রণচণ্ডী, ত্রিশূল হস্তে রুদ্র শিব
জৃম্ভকাস্ত্রে যুদ্ধক্ষেত্রে নিদ্রামগ্ন শত্রুগণ
দর্পণাস্ত্রে যুগ্মনেত্রে তীব্র রশ্মি বিচ্ছুরণ
সপ্তহস্ত লম্ব বংশে তীক্ষ্ণ ফলক যুক্ত প্রাস
বীর হস্তে শক্ত যষ্টি, দুষ্ট-বক্ষে শঙ্কা ত্রাস…
………………………………
এই ছড়া রচনার নেপথ্যকাহিনি
যে সকল
রসিকবন্ধুরা রসাস্বাদনের উদ্দেশ্যে আমার গল্প-কবিতা পাঠ করে থাকেন, তাঁরা এই ছড়াটি
পড়ে একটু হতাশ হবেন। কারণ সাহিত্যের যে ‘ব্যঞ্জনা’ অর্থাৎ যা কাব্যসাহিত্যকে
সার্থক করে তোলে, সেটা এই ছড়ায় ছিটেফোঁটাও নেই। তবে লিখলাম কেন? হ্যাঁ, এটাই আসল
প্রশ্ন, এবং এর সরাসরি উত্তর হচ্ছে ‘লোকশিক্ষা’। এই ‘লোকশিক্ষা’ শব্দটি পড়ার সঙ্গে
সঙ্গে কেউ যদি ভেবে থাকেন যে আমি জ্ঞান দিতে এসেছি তবে সেটা ভ্রান্ত ধারণা, এবং
সেই ধৃষ্টতাও আমার নেই। কেউ হয়তো রবীন্দ্রনাথকে কোট করবেন— ‘লোক
যদি সাহিত্য হইতে শিক্ষা পাইতে চেষ্টা করে তবে পাইতেও পারে, কিন্তু সাহিত্য লোককে শিক্ষা
দেবার জন্য কোনো চিন্তাই করে না। কোনো দেশেই সাহিত্য ইস্কুল-মাস্টারির ভার লয় নাই’ (বাস্তব)। হ্যাঁ, গুরুদেবের কথাটা
শিরধার্য। তবে আমাদের এও ভুললে চলবে না যে বিদ্যাসাগর যদি সাহিত্য রস-চর্চাতেই
নিজেকে ডুবিয়ে রাখতেন এবং বর্ণমালা নিয়ে না ভাবতেন তাহলে কিন্তু আমরা অনেক পিছিয়ে
পড়তাম।
হয়তো
সে কথা ভেবেই এমন কিছু লিখতে ইচ্ছে করে যা সাহিত্যতত্ত্বের দিক থেকে নয়,
সমাজতত্ত্বের দিক থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই ছড়ার টার্গেট মূলত শিশু-কিশোর, এবং
এর নেপথ্যে রয়েছে মূলত চারটি কারণ—
১/ পুরাণকালে
যেসব অস্ত্র-শস্ত্র ব্যবহার হত সে সম্পর্কে একটা ধারণা প্রস্তুত করা। এই ছড়াটিতে
প্রায় ৩১ প্রকার অস্ত্রশস্ত্রের নাম
তালিকাভুক্ত হয়েছে, যেমন— ভল্ল, আগ্নেয়াস্ত্র,
সুদর্শন চক্র, ঢাল-কৃপাণ, তোমর (শাবল সদৃশ), অসি, ব্রহ্ম-অস্ত্র, পট্টিশ (দুই দিকে ধারালো তরবারি বিশেষ), পাশ (প্রায় দশ হাত লম্বা রজ্জুযুক্ত এই অস্ত্র মাথার ওপর একবার ঘুরিয়ে নিক্ষেপ
করে শত্রুকে বেঁধে ফেলা হয়), ধনুর্বাণ, নাগপাশ (শত্রুকে বেঁধে ফেলা
সর্পরজ্জু বিশেষ), গড়ুরাস্ত্র (নাগপাশ-বাণ
বিফলকারী অস্ত্র), বৈষ্ণবাস্ত্র, পাশুপত (শিবের
ত্রিশূল), সীর (লাঙলের মতো অনেকটা, তবে
লৌহ নির্মিত), শক্তিশেল (রাবণ এই
অস্ত্র প্রয়োগ করে লক্ষ্মণকে মৃত্যুমুখে ফেলছিল),
বজ্র, অম্বুবাণ, গদা, হল, কুঠার, শতঘ্নী (একসঙ্গে
একশজনকে প্রহার করার ক্ষমতা রাখে), চন্দ্রহাস (অর্ধচন্দ্রাকার লোহার ফলক), গাণ্ডিব (অর্জুনের ধনুক), খড়্গ, ত্রিশূল, জৃম্ভকাস্ত্র
(এই অস্ত্র প্রয়োগ করলে শত্রু ঘুমিয়ে পড়ে),
দর্পণাস্ত্র (আয়নার রশ্মি দিয়ে
শত্রুর দৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটানো), প্রাস (ছুঁড়ে মারা হয়), যষ্টি (লাঠি, আত্মরক্ষার
জন্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ও সুলভ হাতিয়ার)।
২/ শিশু-কিশোরদের
মনে ও কানে ছন্দবোধ নির্মাণ। এখানে শ্বাসাঘাত প্রধান অর্থাৎ স্বরবৃত্ত/দলবৃত্ত
ছন্দের প্রয়োগ করা হয়েছে, রুদ্ধদল-মুক্তদল একমাত্রা। এখানে পূর্ণ পর্ব চার মাত্রা
করে এবং প্রান্ত্যপর্ব তিন মাত্রার, যেমন--- ৪ + ৪ + ৪ + ৩ । শুধু শেষ পঙক্তিতে
‘বীর’ শব্দটির ‘বী’ দীর্ঘ উচ্চারিত করে এবং ‘র’কে স্বরান্ত উচ্চারণ করে শব্দটাকে
দুই মাত্রায় ধরতে হবে—
১
১ ১ ১
১ ১ ১ ১
১ ১ ১ ১
১ ১ ১
বীর
হস্তে / শক্ত যষ্টি / দুষ্ট-বক্ষে / শঙ্কা ত্রাস…
৩/
উচ্চারণ অনুশীলন। এই ছড়াটা ছন্দ ধরে ধরে দ্রুত পড়তে গেলে যুক্তব্যঞ্জনের অত্যধিক
ব্যবহারের ফলে জিহ্বার দ্রুত স্থানপরিবর্ত ঘটে। ফলে উচ্চারণ-বিভ্রাটের সম্ভাবনা
থাকে। ইংরাজিতে যাকে বলে Tongue Twisters, যেমন— ‘I Wish to wash my Irish
wristwatch’, ‘She Sells sea-shells on the sea-shore’, ‘How much wood would a
woodchuck chuck if a woodchuck could chuck wood?’ ইত্যাদি। এরকম বাংলাতেও অনেক
আছে, যেমন— ‘জলে চুন তাজা, তেলে চুল তাজা’, ‘পাখি পাকা পেঁপে
খায়’, ‘নীল রিলে লাল রিল, লাল রিলে নীল রিল’, ‘কাঁচা গাব পাকা গাব, পাকা গাব কাঁচা
গাব’ ইত্যাদি।
৪/ যুক্তব্যঞ্জনের ব্যবহার (৪৭ টি)— যেসব শিশুরা যুক্তব্যঞ্জন শিখছে তাদের
কাছে এই ছড়াটি লাভদায়ক হতে পারে, কারণ এখানে প্রায় ৪৭ প্রকার যুক্তব্যঞ্জনের
ব্যবহার রয়েছে (হ্যাঁ, দুচারটে অবশ্যই বাদ গেছে, কারণ ছড়ায় বিষয়ভিত্তিক শব্দচয়ন ও
পরিসরের একটা সীমাবদ্ধতা থাকে)। যেমন— ষ্ট, দ্ধ, ক্ষ, ত্র, ম্প, র্য, ত্ম, ল্ল, র্শ,
গ্ন, ব্র, হ্ম, ট্ট, র্ব, র্প, জ্জ, দ্ব, ষ্ণ, ক্ত, স্ত, জ্র, র্জ, ম্ব, ন্ত, ম্ব,
স্ক, ন্ধ, দ্র, ঘ্ন, ন্য, ঙ্গ, ণ্ড, ড়্গ, ণ্ড, দ্র, ম্ভ, গ্ম, শ্ম, চ্ছ, প্ত, ক্ষ্ণ,
প্র, ষ্ট, ঙ্ক ।
বেশ কয়েকটি আবার ত্রিব্যঞ্জনযুক্ত শব্দও রয়েছে, যেমন— স্ত্র (স্+ত্+র),
র্ধ্ব (র্+ধ্+ব), ন্দ্র (ন্+দ্+র) ইত্যাদি।
এছাড়াও প্রতিটি স্বরধ্বনির ব্যবহার রয়েছে, যেমন— অ= অস্ত্র, আ= আত্ম/রক্ষা,
ই= ইন্দ্র/শক্তি, ঈ= বীর, উ= উদ্বেল/যুদ্ধ, ঊ= ত্রিশূল, ঋ= কৃপাণ, এ= হস্তে, ঐ= বৈষ্ণবাস্ত্র,
ও= তোমর, ঔ= শৌর্য ইত্যাদি।
অবশ্য এগুলো আমি সচেতন ভাবে করিনি, পরে খুঁজে খুঁজে বের করেছি। এতে যদি
দশের কাজে লাগে তবে মন্দ কি ?