Saturday 1 May 2021

নগেনের ভূমিকম্প (অণুগল্প)

                                                                         নগেনের ভূমিকম্প (অণুগল্প)

শ্রীবরুণ,
গুয়াহাটি, ০১/০৫/২০২১

        নগেন একজন উঠতি সাংবাদিক। চার বছর ধরে কাজ করছে। কিন্তু আজ অবধি সম্পাদকের কাছে ‘শাবাশ!’ শব্দটা শোনেনি। বিজয় দা-সফিকুল-কাকলি, ওরা তো খুব পারে, কত কি গোপন গোপন খবর জোগাড় করে আনে! আর সে?
        সকাল সকাল কমোডে বসে এসবই ভাবে নগেন। নখ কামড়ায়, আর খুব বেশি অস্থির লাগলে তল পেটে চাপ দিয়ে জোরে জোরে কোঁতে।
        সেদিন সাতটা পঞ্চাশের এলার্ম দিয়ে নগেন পায়খানায় বসেছিল। মোবাইলটা রেখেছিল সাবান-কেসের ওপর। টিঁ-টিঁ-টিঁ-টিঁট্‌ টিঁ-টিঁ-টিঁ-টিঁট্‌। হাত বাড়িয়ে এলার্মটা বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘ চল্লিশ মিনিট আত্মমগ্ন ছিল সে। এবার ফস্‌ করে জলের নলটা ছেড়ে দেয়। নল ও মগের দূরত্ব প্রায় এক ফুট। দুরন্ত জলের ফোর্স ছুটে গিয়ে আঘাত করে প্লাস্টিক-মগের তলানিতে। নগেনের এই মুদ্রাদোষটা পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীই জানে না। এমনকি সে নিজেও না। কমোড থেকে ওঠার আগে মিনিট-খানেক সে নল নিয়ে খেলে। একবার ছাড়ে… তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে, ছাড়ে… বন্ধ করে। ঢেউ ওঠে মগে। ব্যাপারটা দারুণ লাগে তার, কানে বাজতে থাকে জলতরঙ্গ।
        নগেন এবার মগের দিকে তাকায়। জলটুকু পাক খাচ্ছে। আর সেই পাকে পিনপিন করে ঘুরছে একটি পিঁপড়ে। পিঁপড়েটা কি উদ্ধার পাবে, নাকি তলিয়ে যাবে? ভাবতে ভাবতেই মগের জলটা অস্বাভাবিক ভাবে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। সুনামি? হ্যাঁ পিঁপড়েটার জন্য সুনামিই বটে। কিন্তু বেসিনের আয়নাটা ঠকঠক কাঁপছে কেন? ঠাস্‌ করে সাবানের কেসটা পড়ে যায়, সঙ্গে মোবাইলটাও। এতক্ষণে হুঁশ আসে নগেনের। এ তো শুধু মগের জল কাঁপা নয়, কমোডের জলও কাঁপছে, বালতির জলও। কাঁপছে দরজা-দেওয়াল-ফ্লোর সবকিছু।
        সর্বনাশ!
        ভূমিকম্প!!!
        লাফিয়ে ওঠে নগেন! ভাগ্যিস চল্লিশ মিনিট শুধু কুঁতেই পার করেছিল। গামছাটা কোনোমতে পেঁচিয়ে সে ছোটে। তীব্র ঝাঁকুনিতে ঝনঝন করে ভেঙে যায় রান্নাঘরের কাচ। ডাইনিং টেবিলে রাখা ভ্যাট সিক্সটি-নাইন বোতলটাও মেজেতে পড়ে ফটাস করে ফেটে যায়। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। দরজার কপাট খুলে বাইরের গ্রিলটা দুই হাতে প্রাণপণে খোলার চেষ্টা করে সে। ক্যাঁ-কুঁ-ক্যাঁ-কুঁ শব্দ ওঠে মরচে ধরা গ্রিলে। নগেন হাতের গতিবেগ বাড়ায়। ক্যাঁকুঁক্যাঁকুঁক্যাঁকুঁক্যাঁকুঁ। হাতের ঝাঁকুনিতে হঠাৎ ঢিলে হয়ে যায় তার গামছার গিঁট। এক হাতে গামছাটাকে সামলে গ্রিলটা সজোরে ঠেলে সে বেরিয়ে আসে রাস্তায়। তখনও কাঁপছে ধরিত্রী। কাঁপছে তার বুক। ধকধক ধকধক। এরকম কাঁপুনি তো সে বাপজ্জম্মেও দেখেনি-রে-বাবা! পাড়া-প্রতিবেশীরাও উলুধ্বনি দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। নগেনও সামিল হয় সন্ত্রস্ত মানুষদের ভিড়ে। কাঁপুনি কমেছে। তবুও বুকের ধকধকানি কমেনি কারও। আশপাশের মানুষগুলোর দিকে তাকায় নগেন। সবাই ‘ঠাকুর ঠাকুর’ করছে। রজতদার গায়ে শুধু পাঞ্জামি, লিকলিকে ঠ্যাং দুটো এক্সপোজ হচ্ছে। বল্টুর মায়ের হাতে খন্তি, মোমি দির কোলে তার তিন বছরের ঘুমন্ত বাচ্চা, ঘোতনের মুখে ব্রাশ…। আর পাশের বাড়ির শকুন্তলা বউদি! তাকে তো শাড়ি ছাড়া আর অন্য রূপে দেখা যায় না কখনো। বউদির এ কী রূপ! চাপা হাফপ্যান্ট, আর ওপরে… থাক্‌। নগেন চোখটা নামিয়ে আনে। তারপর আবার তাকায়। তখনও বউদির বুকটা ভয়ে ওঠানামা করছিল। নগেনের অন্তরের ধকধকানি দ্বিগুণ বেড়ে যায়। পকেটে হাত ঢোকানোর চেষ্টা করে সে। কিন্তু পকেট কোথায়? শকুন্তলা বউদির চোখ পড়ে নগেনের ওপর, নগেনের সমস্ত কিছুর ওপর। নগেনের শরীরের লোম জেগে ওঠে। গামছার গিঁটটা একহাতে শক্ত করে ধরে সে অন্য হাত দিয়ে সারা শরীর ঢাকার চেষ্টা করে। তারপর ছুট দেয়। বুকে হাত দিয়ে সে ভূমিকম্পের অভিকেন্দ্র অনুধাবনের চেষ্টা করে।
        কী প্রচণ্ড ঝাঁকুনি!