Monday 25 October 2021

দুঃখহীনের কান্না

 দুঃখহীনের কান্না

শ্রীবরুণ, ২৫/১০/২০২১

        পুরাতন লোহা-টিন-প্লাস্টিক সংগ্রহ করার জন্য ভাঙাচোরাওয়ালারা যেভাবে গলিতে গলিতে, রাস্তায় রাস্তায়, পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে সুর তুলে চিৎকার করে বেড়ায়, ‘আছ়ে নাহি গো বাইত্যে… পুরানা লুহা-টিন-প্যালাশ্‌টিক-বতল-প্যাফ়ার-কাগজ়’, ঠিক তেমনি অর্থাৎ একই সুরে যদুরামও চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বেড়ায়। তবে তার সুর একই হলে কি হবে, কথাবস্তু আলাদা, ‘আছ়ে নাহি গো… অন্তরের পুরানা বিশ্‌-ব্যাদ্‌না-দুক্‌খু-কশ্‌টো-জ়ালা…।’

        ছোট্ট গ্রামটির মানুষজন যদুরামের কাণ্ড দেখে হাসে। বলে ‘ব্যাটা আর জ়িনিস পাইল না, মাইন্‌শের দুক্‌খু-কশ্‌টো কিনবার লিগা এই রইদে রইদে ঘুইর‍্যা বেরায়… হাল্লার ব্যাটা হাল্লা প়াগলের পো… হা-হা-হা… ।’ কখনো আবার কেউ কেউ যদুরামকে ডেকে খুব চিন্তিত সুরে বলে, ‘অ-ই! অ-ই জ়দুরাম! আমগোরে এই গেরামে কারোর্‌ই দুক্‌খু-মুক্‌খু নাই রে… তুই অন্যহানে জ়া… পাইর্‌লে টাউনে জ়া… অইহানে মাইন্‌শের অন্তরগুলা দুক্‌খু-জ়ন্ত্রনায় ভইর‍্যা গেছেগা… জ়া অইহানে… ভালো কামাই কইর্‌বার পাবু…।’ বলেই পাশের বন্ধুটির দিকে তাকিয়ে চোখ টেপে।

        যদুরাম বিস্ময়ের সঙ্গে লোকগুলোর দিকে তাকায়, তারপর বিড়বিড় করে কী যেন বলতে চায়, কিছু একটা বোঝাতে চেষ্টা করে। তারপর আবার ছোটে।

        পেছন থেকে আবার অন্য কেউ হয়তো চেঁচিয়ে ওঠে, ‘জ়দুরাম রে, হুনলাম ফ়কুরা গেরামের মাইন্‌শের অন্তরে নাহি ম্যাল্লা ব্যাদ্‌না জ়মা হয়া আছে, বেইচ্‌বার পাইর্‌তাছে না… তুই অইহানে জ়া… শিক্‌গিরি জ়া।’  

        যদুরাম ছোটে। চিৎকার করতে করতে আবার ছোটে, ‘আছ়ে নাহি গো… অন্তরের পুরানা বিশ্‌-ব্যাদ্‌না-দুক্‌খু-কশ্‌টো- জ়ালা …।’

        যদুরামের দু-পায়ে দুই ধরণের চপ্পল। রং ও সাইজ়ও আলাদা আলাদা। রুক্ষ গোঁফদাড়িতে সবসময় ঢাকা থাকে তার আসল চেহেরা। কাঁধে একখানা ছেঁড়া সিমেন্টের বস্তা নিয়ে সে বড় বড় চোখ করে চারদিকে তাকায়। লোকজন আবার তামাশা শুরু করে, ‘কী ভায়া, তুমি যে দুক্‌খু-কশ্‌টো কেনার জ়ইন্যে ঘুইর‍্যা বেরাইতাছো, তা সেগুলা রাইখ্‌বা কোন্‌হানে? তোমার তো ব্যাগ্‌ডাই ছ়েরা…’। কিন্তু সেসব কথায় যদুরামের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে চিৎকার করে করে ছুটে চলে, ‘আছ়ে নাহি গো… অন্তরের পুরানা বিশ্‌-ব্যাদ্‌না-দুক্‌খু-কশ্‌টো-জ়ালা…।’

        সন্ধ্যা হয়ে যায়। প্রতিদিনের মতো শূন্য ছেঁড়া সিমেন্টের বস্তা কাঁধে নিয়ে যদুরাম গ্রামে ফেরে। সেঁচ বিভাগের পরিত্যক্ত ভাঙা ঘরটিতে বসে বসে সে পাউরুটি খায়, আর ভাবে, ‘দুক্‌খু জ়িনিসটার এত্তো দাম! মাইন্‌শে বেইচ্‌বারই চায় না…।’ দুঃখ কেনার জন্য কিছু টাকাও জমিয়ে রেখেছে সে। পকেট থেকে বের করে রোজদিনের মতো টাকাগুলো সে গোনে। তারপর আবার পকেটে গুঁজে রেখে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। কাল আবার বেরোতে হবে তাকে। দুঃখের খোঁজে।  

        কিন্তু তার ঘুম আসে না। হাহাকার করে। ফেটে যায় অন্তর। হা-হুতাশ করতে করতে একসময় হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে। কপাল চাপড়ায়, ‘হায়-হায়! আমার ভাইগ্যে দুক্‌খু নাই রে, এহন আমি ক্যামনে থাকুম রে… হায়-হায়-হায়! আমার অন্তরে এক ফোটাও দুক্‌খু নাই রে…।’

        পরের দিন আবার সূর্য ওঠে। লোকজন যদুরামকে নিয়ে মশকরা শুরু করে, ‘জ়দুরে, আরেকটু আগে আইলি না ক্যান্‌ ভায়া… এইমাত্র আমি আমার ব্যাবাক্‌ পুরানা কশ্‌টো-জ়নত্রনা অইন্যের কাছ়ে বিক্‌রি কইর‍্যা দিলাম রে… ইশ্‌ ইশ্‌ ইশ্‌… খানিক আগে আইলে তুই-ই কিন্‌বার পারতি রে…।’

        যদুরাম হতাশ-চোখে তাকায়, তারপর ‘হায়-হায়’ করতে করতে আবার ছোটে; গলিতে গলিতে, রাস্তায় রাস্তায়, পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে চিৎকার করতে থাকে— ‘আছ়ে নাহি গো… অন্তরের পুরানা বিশ্‌-ব্যাদ্‌না-দুক্‌খু-কশ্‌টো-জ়ালা…।’

        সবাই হাসে। হাসতেই থাকে। 

No comments:

Post a Comment