প্লুটোর বিলাপ
১ — প্রশ্ন-উত্তর পর্ব
(১) সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও—
....................................
....................................
জ) পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নদীদ্বীপ কোনটি?
উত্তরঃ মাজুলি, অসম
কারেক্ট । এক নম্বর (লাল কালি দিয়ে)।
ঝ) মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম কী?
উত্তরঃ হোমো সেপিয়েন্স
কারেক্ট । এক নম্বর (লাল কালি দিয়ে)।
ঞ) সৌরমণ্ডলে গ্রহ কয়টি?
উত্তরঃ আটটি
ঘ্যাঁচ্-ঘ্যাঁচ্ (লাল কালি দিয়ে)।
শেষের অশুদ্ধ
ক্রস চিহ্নটি একবার রিফ্লেক্ট করল ঘোষাল মাস্টারের বতলের তলির মতো মোটা চশমায়। যদিও তিনি উত্তরটি কেটে দিয়েছেন, তবুও কেন-যেন সহজ হতে পারছেন না। বেশিবেশি
জানলে যা হয়।
কোল থেকে বালিশটা পাশে রেখে গুনতি শুরু করলেন। ঊনআশি। আবার গুনলেন। ঊনআশি। কি মুশকিল! এক নম্বরের জন্য বেচারা লেটার থেকে মার খাচ্ছে! আবার সুড়ঙ্গ খুঁজতে লাগলেন। খুঁজতে খুঁজতে পেছন থেকে বড় প্রশ্নগুলি পেরিয়ে, টীকা পেরিয়ে, দুই নম্বরের প্রশ্নগুলি
পেরিয়ে আবার এসে ‘একের-ঞ’— সৌরমণ্ডলে গ্রহ কয়টি?
ঘোষাল মাস্টারের প্রিয় বিষয় বিজ্ঞান, বিশেষ করে এ্যাস্ট্রোনোমি। বাইরের
বিভিন্ন খুঁটিনাটি তথ্য, সায়েন্স জার্নাল, ম্যাগাজিন, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি,
ডিস্কোভারি, এনিমেল প্ল্যানেট থেকে শুরু করে খবরের কাগজ, এমন-কি ফুটপাতের কুইজের
বই পর্যন্ত, সব জায়গাতেই তাঁর তীক্ষ্ণ নজর। শহরে গিয়ে প্ল্যানেটরিয়ামের এক-একটা এপিসোড চোদ্দবার করে
দেখেন। বিজ্ঞান নিয়ে একটু বেশি-বেশি করাটা তাঁর স্বভাব। বিপদেও পড়েন সে-জন্য। এই স্বভাবদোষের ফলে প্রায়ই তিনি সিলেবাস
ডিঙিয়ে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যান গ্রহ-তারা-নক্ষত্রের দুনিয়ায়। আকাশগঙ্গা, ধ্রুবতারা, ধূমকেতুর সঙ্গে পরিচয়
করিয়ে দেন। চন্দ্র থেকে জুপিটার হয়ে (ভায়া তারকামণ্ডল) তিনি সূর্যের একেবারে
কাছাকাছি পৌঁছে যান। শীতের রাতে আগুন পোয়ানোর মতো দুই হাত সেকে নেন সূর্যে। তারপর একটা
সেফ্টি জোনে দাঁড়িয়ে ছেলেপিলেদের গলিত লাভার টগবগানি শোনান। অবশ্য এর
চাইতে বেশি এগোনোর সাহস নেই তাঁর। মাস্টারবাবু ভালো করেই জানেন
যে, আর এক-পা এগোলেই জ্ঞানের উত্তাপে ভস্মীভূত হয়ে যাবেন তিনি। আর বিজ্ঞানের
টেম্পারেচারে সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের ঘিলু ফেটে গিয়ে এদ্দিন ধরে অর্জিত সমস্ত জ্ঞানটুকু শিমুল তুলার মতো ছড়িয়ে
পড়বে গোটা স্কুলে।
সৌরমণ্ডলে গ্রহসংখ্যা বিষয়টি এতদিন ঘোষালবাবু আট-নয়ের মধ্যেই ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু কে জানে, যে এবার স্বয়ং
হেডমাস্টার বিজ্ঞানের পেরারটা সেট করবেন! উপায়? একদিকে মেধাবী ছাত্রটির লেটার নম্বর নিয়ে টানাটানি,
সৌরমণ্ডলের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ, আর অন্যদিকে পাঠ্যপুস্তকের অবমাননা। ঠুস্ করে কলমের মাথাটা
ভেঙে গেল। কলমে দাঁতের ছাপ স্পষ্ট।
সত্যম্-শিবম্-সুন্দরম্। ক্যালেন্ডার থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার খাতায় চোখ রাখলেন
ঘোষালবাবু। নাহ, সৌরমণ্ডলের সঙ্গে তিনি কখনোই কম্প্রোমাইজ করতে পারেন না। আইডিওলজি
বলে কথা। পুস্তকে যাই থাকুক না কেন, ২০০৬ থেকে অন্তত এটাই সত্য যে, বর্তমান
সৌরমণ্ডলে গ্রহের সংখ্যা আট। প্লুটোর নাম কাটা পড়েছে। ১৯৩০ সালে clyde Tombaugh যে
নবমগ্রহটি আবিষ্কার করেছিলেন, ছিয়াত্তুর বছর সৌরজগতের কক্ষপথে ঘোরাঘুরি করে গ্রহটি
অবাধ্যের মতো লক্ষণ রেখা পার করেছে। অর্থাৎ ভ্রষ্ট হয়েছে। কোথায় গ্যাছে? গ্যাছে সংসারের বাইরে। তাই আজকের তারিখে বিজ্ঞান
স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে যে, সৌরজগতে গ্রহ-সংখ্যা আট। কিন্তু পুস্তকেতো এখনও নটাই
আছে বুধ-শুক্র-পৃথিবী-মঙ্গল-বৃহিস্পতি-শনি-ইউরেনাস-নেপচুন এবং প্লুটো। নতুন প্রিন্ট
কবে আসবে ভগবান জানেন। আদৌ নতুন প্রিন্টে নতুন তথ্য থাকবে কি না! নাকি চাপ্টারটাই উঠে যাবে! তবে,
যাই হোক না কেন প্রকৃত সত্যটি কিন্তু স্বীকার করতেই হবে। সৌরমণ্ডলের সঙ্গে কোনো
মতেই কম্প্রোমাইজ হতে পারে না।
খাতায় লাল রঙের ক্রোস দাগটি কায়দা করে মুছে দিলেন মাস্টার মশাই। সৌরমণ্ডলে গ্রহ
আটটি। রাইট। একবার চোখ বন্ধ করে ঘোষালমাস্টার মহাকাশটা কল্পনা করার চেষ্টা করলেন। বুধ-শুক্র-পৃথিবী-মঙ্গল-বৃহস্পতি-শনি-ইউরেনাস-নেপচুন।
হ্যাঁ, আট নম্বর গ্রহের পর সমস্ত কিছু শূন্য। খাতাতেও বসল আটের পর শূন্য। লেটার। আহ
শান্তি! সঙ্গে সঙ্গে মাস্টার মশাইয়ের ডান পাশের গাল ও ঠোঁট-সংলগ্ন জায়গাটিতে ভেসে
উঠল একটি হাসির খাল।
কিন্তু হঠাৎ আরেকটা কথা ভেবে তাঁর কপালের রেখাগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠল। লেটার পাওয়া
ছাত্রদের খাতা যদি হেডমাস্টার রি-চেক করতে বসেন! এবং তা করতে গিয়ে যদি প্রশ্ন করেন
‘কি-হে ঘোষালবাবু! সৌরমণ্ডল নিয়ে আপনার মাথা কি গুলিয়ে গ্যাছে নাকি? আট লিখলেও
শুদ্ধ, আবার নয় লিখলেও শুদ্ধ, ব্যাপারটা কী হ্যাঁ! আপনি কি বই থেকেও বেশি জানেন
নাকি, বই টপকে যাচ্ছেন যে?’।
ঘড়ির কাটার টিক-টিক শব্দ যেন দ্বিগুণ বেড়ে গ্যাছে। নাকটা কুঁচকে ঘোষালবাবু দাঁত বসানো কলমটি
আবার কামড়াতে শুরু করলেন। তারপর হঠাৎ কি যেন ভেবে জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশটার দিকে
উঁকি মারলেন। অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। যেন সূর্য আকাশের সমস্ত দায়িত্ব চাঁদকে
সমঝে দিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আর ভোলাভালা চাঁদের সরলতার সুযোগ নিয়ে আকাশের তারাগুলো দুরন্ত
শিশুর মতো মিটমিট করছে, খিলখিল করছে আর একটি অপরটিকে ধরার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। অই-অই-অই-তো
অই-তো একটা তারা ছুটে গেল অই দিকে!
ইস! চন্দ্র-সূর্য-তারার মতো যদি গ্রহগুলিও খালি চোখে দেখা যেত! বিশেষ করে
প্লুটোটাকে! ভাবতে ভাবতে ঘোষালবাবু একটি বিশাল বড় হাই তুললেন এবং পাশের বালিশে
ঢুলে পড়লেন।
২— স্বপ্নপর্ব
‘ঙঙঙনখখখখ...পফ্ফবউউউউ......ঙঙঙনখখখখ...পফ্ফবউউউউ......ঙঙঙনখখখখ...পফ্ফবউউউউ......’—
ঘোষালবাবুর নাক ডাকার শব্দে শুধু ধরিত্রী নয়, শুধু সৌরজগত নয়, সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড
কেঁপে উঠছিল। আর সেই অন্ধকার ব্রহ্মাণ্ড থেকে কে যেন মুখটি গোমরা করে তাঁর সম্মুখে
এসে হাজির। তারপর প্রতিবাদের সুরে বলতে লাগল—
‘কি স্যার... চিনতে পারছেন? ভালো করে দেখুনতো’
ঘোষালবাবু উৎসাহের সঙ্গে ‘প্লুটো না!’
‘ঠিক ধরেছেন স্যার। আমি প্লুটো। প্লুটো প্ল্যানেট। যার নামে আপনারা সৌরজগতের সবচাইতে এবানডোনড, আনপ্রডাক্টটিভ
ও ইউজ্লেস জায়গাটুকু বরাদ্দ করেছিলেন। একেবারে সবার পেছনে, দূরে, অন্ধকারে।’
‘কি বলছ তুমি, হাঁপাচ্ছ কেন এত? একটু জিরিয়ে নাও বাছা’
‘না স্যার। আসলে আপনার মতো নিষ্ঠাবান বিজ্ঞানের সাধক তারকারাজ্যের ওপারের দু-চারটে
গ্রহে থাকলেও থাকতে পারেন, কিন্তু এ জগতে যে নেই তা নিশ্চিত ছিলাম এতদিন।’ বাক্যটির শেষ শব্দদুটো শোনার
আর ধৈর্য হল না মাস্টার মশাইয়ের। উৎসাহের সঙ্গে বললেন—
‘অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। বেঁচে থাকো বাছা। কিন্তু হঠাৎ কী মনে করে এই কুটিরে?’
প্লুটো হাসতে হাসতে— ‘আপনি একদিকে বেঁচে থাকার বর দেন, আর অন্যদিকে গলা টিপে মারার
পরিকল্পনা করেন। ভারি আশ্চর্য!’
ঘোষাল মাস্টার প্লুটোর বক্তব্যটি ধরতে না পেরে আমতা-আমতা করে জিজ্ঞাসা করলেন—
‘কেন, কী হয়েছে? কী করলাম? আর কেনই-বা এভাবে বলছ?’
‘আসতাম না স্যার। মনের দুঃখে আপন মনেই ঘুরে বেরাচ্ছিলাম এদিক-সেদিক। কিন্তু যখন
দেখলাম অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মতো আপনিও আমায় সংসার থেকে তাড়াতে কোমর বেঁধেছেন, তখন
আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। নইলে ওই ছেলেটি লেটার নম্বর পায় কী করে! খাতায় গ্রহ
সংখ্যা আট লেখার পরও আপনার মতো বিজ্ঞ পণ্ডিতের হাতে রাইট চিহ্ন, কি আশ্চর্য! আমার
অস্তিত্বটাই মুছে দিলেন! আর আশীর্বাদ দিচ্ছেন বেঁচে থাকো!’
‘শোনো বাছা, এতে আমার কোন্নও দোষ নেই। তোমার মধ্যে যে গ্রহত্বের অভাব সে-কথা
ইতিমধ্যে বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে।’
‘সরি স্যার, আপনার কথা আমি মানতে পাচ্ছি না। আমি যা ছিলাম, এখনও তাই আছি। তবে হ্যাঁ,
আমায় তাড়াবার উদ্দেশ্যে আপনারা গ্রহের সংজ্ঞাটাই বদলে দিলেন। আর এখন বলছেন আমি
ডিস্কোয়ালিফাইড্!’
‘না-না প্লুটো, মিছিমিছি তুমি সেন্টিমেন্টাল হচ্ছো। তোমার প্রতি আমার স্নেহ বরাবরই আছে। কিন্তু
বিজ্ঞান যে যুক্তি দেখাচ্ছে সেখানে তোমার মধ্যে গ্রহত্বের অভাব ধরা পড়ে গ্যাছে
বাছা।’
প্লুটো মুখটা সংকুচিত করে— ‘গ্রহত্ব? কীসের গ্রহত্ব? আচ্ছা আপনিই বলুন তাহলে,
আপনি তো মানুষ। আপনার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে। কিন্তু জীবনে কখনও যদি সেই মনুষ্যত্বে ফাটল
ধরে তখন কি আপনি আর মানুষ হয়ে থাকবেন না! নাকি?’
‘সেকথা কেন হবে। আসলে কুইপার বেল্টে তোমার মতো আরও বেশ কিছু অবজেক্ট আছে বলে বিজ্ঞানীরা
মনে করেন।’
‘আমাকে অযথা ছোটো করার অধিকার কিন্তু আপনার নেই স্যার। অবজেক্ট কেন বলছেন আমাকে। অবশ্য মনুষ্য
জাতির ওপর বেশি আশা করেও বা লাভ কি! মরার সঙ্গে সঙ্গে আপনারা নিজের মাকেই ডেড্বডি
বলে সম্বোধন করেন, আপনাদের মনুষ্যত্ব নিয়ে আর কি বলব! অথচ আপনারা নিজেদের মানুষ
বলেই গণ্য করেন, হা হা হা...’
‘দ্যাখো প্লুটো, কুইপার বেল্টে বিজ্ঞানী মাইক ব্রাউন ঠিক তোমার মতোই আরেকটি
খাসা অবজেক্ট, সরি সরি, অই রকম একটা কিছু খুঁজে পেয়েছেন। আর তার নাম দিয়েছেন ‘এরিস’। এছাড়াও লাইনে রয়েছে
সেরেস, প্যালাস, জুনো, ভিস্তা ইত্যাদি অবজেক্টগুলো। গ্রহত্বের সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য ওরা
অনেক আগেই এপ্লাই-টেপ্লাই করে রেখেছে। এখন তুমিই বলো, উদ্বাস্তুদের মতো যেই আসবে
তাকেই পক্ষপথে জায়গা দিতে হবে নাকি! এমনিতেই ছাত্ররা গ্রহগুলির নাম মনে রাখতে হিম্সিম্
খাচ্ছে! তার উপর যদি অনাহূতরাও এসে চেপে বসে তাহলে তো গোটা...’
মাস্টার মশাইয়ের মুখ থেকে বাক্যটা চট্ করে কেড়ে নিয়ে প্লুটো আস্ফালন করে বলে
উঠল— ‘গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জানেনই-বা কতটুকু আপনারা? ব্রহ্মাণ্ডটা সূর্যও কিনে
রাখেনি আর বিজ্ঞানী মাইক ব্রাউনও কিনে রাখেনি। আর তাছাড়া আমি যদি অবজেক্টই হতাম
তাহলে আমার গ্রহত্ব নিয়ে এত প্রশ্ন কেন? ২০০৬-এর আগস্টে ইন্টারন্যাশনাল
অ্যাসট্রোনোমিক্যাল ইউনিয়নের জেনারেল অ্যাসেম্ব্লিতে আপনারা আমার গ্রহত্ব নিয়ে
ভোটাভোটি করতে গেলেন কেন? আপনারা নিজেরাই সংশয়ের মধ্যে। হ্যাঁ, বলে দিলাম, একদিন
আপনারাই অনুশোচনায় ভুগবেন। মাত্র কয়েকজন স্বার্থপর বিজ্ঞানীর চক্রান্তেই আজ আমার
এই দুর্দশা। উপায় না পেয়ে ব্যাটারা আমার নতুন নামকরণ করলেন ডোয়ার্ফট্ প্ল্যানেট।
তার মানে কী? উপেক্ষিত! অস্পৃশ্য! ছিন্নমূল!
ডি ভোটার! নাকি সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন!’ এতই যদি সমস্যা তাহলে আমাকেও কোনো ডিটেনশন
ক্যাম্পে ঢুকিয়ে রাখুন-না। পারবেন?
‘তুমি যাই বলনা কেন প্লুটো, এখন কিন্ত এটাই
প্রতিষ্ঠিত যে সৌরমণ্ডলে গ্রহসংখ্যা আট। আর এর সপক্ষে যুক্তিও
আছে।
প্লুটো একটু গম্ভীর হয়ে— ‘কী যুক্তি? আমি কি দেখতে অন্যদের মতো নই? আমি কি
ত্রিভুজ!’
‘না না, ত্রিভুজ হবে কেন! অবশ্যই গোলাকার। এবং তোমার মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি
আছে বলেই তুমি গোলাকার। কিন্তু...!’
‘কিন্তু
কী? আমি কি সূর্য বন্দনা করতে গিয়ে তাকে প্রদক্ষিণ করি না?’
এবার
ঘোষাল মাস্টার একটু নড়েচড়ে বসলেন। অনেকক্ষণ পর একটা ভালো যুক্তি মাথায় এসেছে।
সুরটা একটু কোমল করেই তিনি বললেন—
‘তা
করো বটে, কিন্তু সেখানেই-তো তুমি নিয়ম ভাঙছ!’
‘কীভাবে?’
‘অন্যরা
যেভাবে শাস্ত্র মেনে প্রদক্ষিণ করছে, তুমি তো সেভাবে করছ না। খেয়াল-খুশি মতো একটা
অ্যাঙ্গেলে চলো। তাই অনেকেই বলে তুমি নাকি তেরিয়া। আর তাছাড়া এতই অন্য-মনস্ক থাকো
যে অন্যের কক্ষপথেও ঢুকে পড়। অনেকে আবার তোমাকে মাতাল ভেবেও রিপোর্ট করেছে।’
এবার
প্লুটো ক্ষেপে উঠেছে— ‘আমি যদি বলি সেটা আমার কক্ষপথ, বরং নেপচুনই আমার রাস্তায়
ঢুকে পড়ে! তখন?’
ঘোষাল
মাস্টার একটু হাসলেন, তারপর একটু জিরিয়ে নিয়ে উত্তর দিলেন— ‘সেটা কেউ মানবে না
প্লুটো। কারণ
নেপচুন তোমার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী, অস্তিত্ব সম্পন্ন এবং ওজনদার গ্রহ।’
‘তাঁর
মানে আপনি কি বলতে চাইছেন যে, যার ওজন যত বেশি সেই অগ্রাধিকার পাবে? সারভাইবেল অফ
দ্য ফিটেস্ট? তাহলে তো ব্যাপারটা আপনাদের মন্ত্রি-এমেলের মতোই দাঁড়াল। যার টাকা
আছে সেই ইলেকশন খেলবে। সেই বড় হবে। বাকিরা সব পনেরো-আনা। স্থান পায়ের তলায়।’
‘আজকাল
এটাই তো নিয়ম বাছা। তবে হ্যাঁ, তুমি যদি এই দুর্বল ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে এক-আনার দলে
আসতে চাও তবে তোমাকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তুমি অত্যন্ত কুড়ে! মাত্র
একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতেই তুমি আড়াইশ বছর কাটিয়ে দাও। এভাবে চললে হবে? শোনো
প্লুটো, তোমাকে অত্যন্ত স্নেহ করি বলেই বলছি, গ্রহ মর্যাদা যদি ফিরে পেতে চাও তবে
একটু সচেতন হও, নিজের অস্তিত্ব উপলব্ধি করো, শক্তি সঞ্চয় করো, ওজন বারাও, নিজের
রাস্তা খোঁজো এবং নিজের পথে চলো। অন্যথা নিজেকে গ্রহ বলে কল্পনা করো না।’
প্লুটো
একটু সময় মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। তারপর অ্যাটাকিং সুরে আবার বলতে শুরু করল—
‘কোনটা সত্য,
কোনটা মিথ্যে সেটা কেবল মাত্র আপনারাই ঠিক করবেন! বাকিরা সেটাকে বেদবাক্য বলে মেনে
নেবে! বাঃ কি সুন্দর মনুষ্যত্ব! এতক্ষণ আপনি যা বললেন সেগুলির সমস্তটাই
মনুষ্যসমাজকে নিয়ে, মানুষের অনুভূতি নিয়ে। আপনাদের নিয়ম-কানুন সৌরমণ্ডলে কেন
খাটানোর চেষ্টা করছেন? তবুও ঠিক আছে স্যার, মেনে নেব। কিন্তু আপনাকেও কয়েকটি
প্রশ্নের জবাব দিতে হবে’
মাস্টার মশাই চোখগুলি বড় বড় করে— ‘কী প্রশ্ন?’
‘অস্তিত্বের প্রশ্ন। ছেলেবেলা থেকেই আপনারা শিখিয়ে এসেছেন এক-এ চন্দ্র, দুই-এ পক্ষ। তাই না?’
মাস্টার মশাই খুব উৎসাহের সঙ্গে— ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ।
তারপর তিন-এ নেত্র, চার-এ বেদ’
‘ঠিক বলেছেন স্যার। তারপর পাঁচে?’
‘পঞ্চবাণ’
‘ছয়-এ?’
‘ঋতু’
‘সাত-এ?’
‘সমুদ্র’
‘আট-এ?’
‘বসু’
‘নয়-এ’
‘নবগ্রহ?’
‘থামুন থামুন থামুন স্যার। কী বললেন? নয়-এ কী’
‘নবগ্রহ’
‘কেন কেন কেন? তা কী করে হয়, আমাকে যদি গ্রহ থেকে আপনারা
বাদই দিলেন তাহলে নবগ্রহ এল কীকরে? দম থাকে তো বসুদের তাড়িয়ে আট-এ অষ্টগ্রহ করুন
দেখি!’
এবার ঘোষালবাবু একটু থতমত খেয়ে— ‘তোমার কথায় যুক্তি
আছে প্লুটো। তবে একথাও সত্য যে চট্ করে প্রচলিত কিছু পাল্টে গেলে প্রথম প্রথম
একটু মেনে নেওয়া অসুবিধে। তবে কালে-কালে মানুষ নয়-এ নবগ্রহ আর বলবে
না, দেখো। আমি আর কদিনই-বা থাকব এই দুনিয়ায়। কিন্তু তুমিতো থাকবে। দেখো, আমার
কথাটা সত্য বলে প্রমাণিত হবে।’
প্লুটো উচ্চকণ্ঠে— ‘ঠিক বলেছেন স্যার। আপনি এই জগতে
চিরস্থায়ী নন। আমি কিন্তু আপনার পরেও থেকে যাব। তবে একথাও জানিয়ে রাখি যে আমি
কিন্তু আপনার জন্মের আগেও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছিলাম। নবগ্রহ কি শুধু ছড়ার ছন্দে আবদ্ধ?
যুগ-যুগ ধরে পৃথিবীর কোনাকাঞ্চিতে ব্যাঙের ছাতার মতো যে নবগ্রহ মন্দির গড়ে উঠেছে
সেগুলির কী হবে? আট-এ না হয় অষ্টগ্রহই
পড়বে ছেলেমেয়েরা, কিন্তু মন্দিরের বেলা?’
মাস্টারমশাই চুপ। নাকটা কুঁচকে কি একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু খেই হারিয়ে ফেললেন।
প্লুটো মাস্টারবাবুর নাকটাকে টার্গেট করে— ‘নাকটা কুঁচকে লাভ নেই স্যার। সব রকম গন্ধেই আপনারা নাসাকে অতিমাত্রায় ভরসা করে থাকেন, যেন নাসাই
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা চালাচ্ছে! কিন্তু জানবেন, নাসাতেও রন্ধ্র আছে। যুগ যুগ ধরে তারা-তো কেবল মহাকাশটাকেই
জানার চেষ্টা করছে। কিন্তু জেনেছে কতটুকু? সমুদ্র থেকে এক কলস জল তুললেই কি সমুদ্রমন্থন হয়!’
একটু সময় দুজনেই চুপ। তারপর একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে প্লুটো আবার নবগ্রহ
মন্দিরের প্রসঙ্গ টেনে বলতে শুরু করল—
‘আপনি হয়ত বলবেন মন্দির কি ভাঙা যায় না? সোমনাথ মন্দির কি লুণ্ঠিত হয়নি? ধর্ম বিদ্বেষে
মন্দির কি ভাঙা পড়েনি? পড়েছে। আর সৌরমণ্ডলের দূরসম্পর্কীয় এক গ্রহের অকাল-মৃত্যুতে
আপনার মতো সুলতান মামুদদের হাতে নবগ্রহ মন্দির ভাঙা পড়তেই পারে। কিন্তু, বিশ্বাসই আসল
কথা স্যার। বিশ্বাসের জোরেই সমস্ত কিছু টিকে আছে। মানুষের মনের মধ্যে নবগ্রহ যে জায়গা করে
রয়েছে তা আপনি মেটাবেন কী করে?’
কথাগুলি শেষ হতে না-হতেই প্লুটো হঠাৎ করজোড় করে মুদিত-নয়নে ঘোষাল মাস্টারের
চারদিক প্রদক্ষিণ করতে লাগল। বৃত্তাকারে নয়, সতেরো ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে,
উপবৃত্তাকারে। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে গুরুমন্ত্র—‘গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু, গুরু
দেব মহেশ্বর। গুরু সাক্ষাৎ পরমব্রহ্মা, তাস্মাই শ্রী গুরুদেব নমঃ’। ঘোষাল
মাস্টারের ভাঙা দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে প্লুটোকন্ঠে উচ্চারিত সেই অমৃত বাণী। চারদিকে
ধূপের গন্ধ, দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারগুলি উড়ছে, ঘড়ির কাঁটা নিস্তব্ধ, আর ঘোষাল
মাস্টার হতবাক হতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁর বিছানার পাশে।
ততক্ষণে
প্লুটো বিছানা ডিঙিয়ে পৌঁছে গেছে জানালার কাছাকাছি। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে চুপচাপ
বেরিয়ে যাবে সে। বিদায়ের আগে ভারি ভারি গলায় তার মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়ে এল
একটিমাত্র বাক্য— ‘ভালো থাকবেন’।
প্লুটো অনায়াসে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ঘোষাল মাস্টার ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলেন।
প্লুটোর শরীর ভিজে গেছে ঘোষাল মাস্টারের চোখের জলে। কিছুতেই থামছে না কান্না।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তারপর তিনি উন্মাদের মতো বলতে শুরু করলেন— ‘যেও-না বাছা, যেও-না… আমায় ছেড়ে যেও-না তুমি। কথা-দিচ্ছি, কথা-দিচ্ছি, আর আমি এসব করব না। সত্যি বলছি ওই ছেলেটার নম্বরটা আমি কেটে দেব। সৌরমণ্ডলে তুমি আছো, এই
সংসারে তুমি আছো, তোমাকে আর অবহেলা করব না। নিজের শখ-আহ্লাদ-আদর্শ তোমার ওপর
চাপাবো না বাছা... এই দ্যাখো, এই দ্যাখো, এই দ্যাখো... দেব না লেটারমার্ক্স… এই-এই অ্যাক্খুনি কেটে দিচ্ছি
দ্যাখো… অ্যাক্খুনি, অ্যাক্খুনি দিচ্ছি’—এই বলে বালিশের নিচে খাতাটা হাতড়াতে লাগলেন।
৩— স্বপ্নভঙ্গ পর্ব
হ্যাঁ, ঘুমের ঘোরে ঘোষালমাস্টার সত্যিই খাতাটা হাতড়াচ্ছিলেন। উন্মাদের মতো হাতড়াচ্ছিলেন। তার চোখের জলে
ভিজে গেছে আস্ত বালিশ। সম্বিত ফিরে পেয়ে তিনি বতলের তলির মতো চশমাটা
থুতনি থেকে উঠিয়ে যথাস্থানে লাগালেন। বালিশটা ঠিক করলেন। চুপচুপে। কোঁচকানো খাতাটা
আবার হাত দিয়ে সমান করার চেষ্টা করলেন। ভাগ্যিস্ খাতাটা ভেজেনি! কখন-যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝতেই পারেননি। বলাবাহুল্য, চোখ দুটো
তখনো ছলছলে।
প্লুটো কোথায়? হঠাৎ তার ফোলা-ফোলা চোখে ভেসে উঠল নিজের সন্তানের প্রতিচ্ছবি। বিজ্ঞান
পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়ার অপরাধে ঘর থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলেন তিনি। বিপত্নীক ঘোষালমাস্টারের জীবন সংসারের কক্ষপথে সেই একমাত্র সন্তানটি আজ অবধি ফেরেনি।
..............................
No comments:
Post a Comment