ওথেলোর অন্য এক অধ্যায় (এক মিনিটের গল্প)
বরুণ কুমার সাহা, গুয়াহাটি, ০৮/০৪/২০১৭
‘শুনুন শুনুন শুনুন… মহান নাট্যকার সেক্সপিয়রের ওথেলো…ওথেলো…ওথেলো…(প্রতিধ্বনিত), পরিচালনায় গৌতম দেবনাথ, রামদাস প্রেক্ষাগৃহে আজ সন্ধ্যা সাতটা থেকে… শুনুন শুনুন শুনুন…’। ধীরে ধীরে প্রচার ভ্যানের গগন কাঁপানো আওয়াজ হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেল। নাক থেকে কি যেন বের করে গুলটি করতে করতে বাগচি স্যার টিউশনের ছাত্রদের কড়া নির্দেশ দিলেন— ‘ডোন্ট মিস ইট… … নেক্সট্ সেমিস্টারে কিন্তু আছে’। ছোট্ট শহরটির বৃদ্ধরাও খুব খুশি, অনেকদিন পর এখানে নাটক-ফাটক হচ্ছে। আর এক বিশেষ শ্রেণিরাও খুশি। নাট্যকারের নামের প্রথম অংশটুকু শুনেই তারা আহ্লাদিত। ‘পিয়র’- পর্যন্ত যাওয়ার ধৈর্য এবং ক্ষমতা দুটোই তাদের থেকে হাজার মেইল দূরে।
‘এই... হয়নি... হয়নি... এক্সপ্রেশন কোথায়!’ গৌতমবাবু স্ত্রী বাসন্তীকে শাসাচ্ছেন। এত ভালো ভালো অভিনেত্রী থাকা সত্ত্বেও গৌতমবাবু কেন নিজের স্ত্রীকেই নায়িকা দেসদিমোনার পার্টটা দিলেন তা রহস্যময়। এ নিয়ে ফিস্-ফাস্ও চলছে মুখে মুখে। ‘এটাতো পারসিয়াল্টি... দেখবে নাটকটা নির্ঘাত ডুববে... বৌদি জীবনে মঞ্চে উঠেছে নাকি কোনোদিনও?’— হিরোয়িনের পার্ট থেকে বঞ্চিত সুজাতা একটু বিরক্তির সুরে বান্ধবীকে বলল। সে-তো আর জানত না যে নাট্য-বিশারদ গৌতম বাবু সুপরিকল্পিত ভাবেই বিষয়টা ভেবেছেন। আর তাছাড়া তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কারও টু-শব্দ করার সাহস নেই। গৌতমবাবুই এই নাটকের প্রাণ। তিনিই পরিচালক, তিনিই প্রযোজক, আবার তিনিই নাটকের নায়ক ওথেলো।
প্রেক্ষাগৃহ উপচে পড়েছে। বোদ্ধারা বেশ উপভোগ করছেন নাটকটা। ছাত্ররা খাতা-কলম নিয়ে ‘কি লিখব কি লিখব’ ভাবছে। বৃদ্ধরা গুড়টুকু আগে খেয়ে বাদাম চুষছেন, চোখদুটো তাঁদের অবতার পুরুষের অপেক্ষায়। আর সেই বিশেষ শ্রেণির দর্শকরা এখনও নাট্যকারের নামকরণের সার্থকতা উপভোগের উদ্দেশ্যে পকেটে হাত দিয়ে গোপনাঙ্গ চুলকানোর চেষ্টা করছে।
নাটকের শেষ দৃশ্য। দেসদিমোনা বিছানায় ঘুমিয়ে। ঘরে মিট্ মিট্ করে আলো জ্বলছে। দুষ্টের প্ররোচনায় স্বামী ওথেলো ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ঘরে ঢুকেছে। আজ সে তার ভালোবাসাকে গলা টিপে মারবে। ক্রোধে, দুঃখে জর্জরিত ওথেলো শেষবারের জন্য নিজের স্ত্রীর কপালে চুমু খেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রেক্ষাগৃহের সেই বিশেষ শ্রেণির দর্শকটিও উঠে বসল, হাত তার পকেটে। দেসদিমোনা সাড়া পেয়ে বলছে—
‘কে ওখানে? ওথেলো?’
‘আমি, দেসদিমোনা’
‘আপনি কি শয্যায় আসবেন, প্রভু’
নাটকের সংলাপগুলি শুনে বাগচি স্যারের চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে উঠল। এই লাস্ট সিনটার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে পাশের সিটে বসে থাকা প্রিয় ছাত্রীর বুকে একবার কনুই দিয়ে খোঁচা দিলেন। অনূদিত সংলাপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারপর নিজে নিজেই ইংরাজি সংলাপগুলি আওড়াতে লাগলেন—
‘Out strumpet : weep’st thou for him to my face?’
‘Kill me tomorrow, let me live tonight.’
‘Nay, if you strive’
‘But half an hour.’
মঞ্চে গৌতমবাবু ওথেলো ক্যারেকটারের সঙ্গে একেবারে মিশে গেছেন। দেসদিমোনার করুণ মিনতি অগ্রাহ্য করে ওথেলো মঞ্চ কাঁপিয়ে বলে উঠল সেই হৃদয় বিদারক বাক্যটি। বাগচি স্যারও সুযোগ পেয়ে ছাত্রীকে শেষ খোঁচাটা মেরে উত্তেজিত ভাবে বললেন —
‘It is too late’
সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চ কাঁপানো ঝঙ্কার। ওথেলোর চোখে আগুন। দুই হাত দিয়ে স্ত্রীর গলা টিপে ধরেছে ওথেলো। মঞ্চের আলো জ্বলছে-নিভছে জ্বলছে-নিভছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে দেসদিমোনা। নাটকের ক্লাইমেক্স। ডুক-ডুক-ডুক-ডুক করে গম্ভীর সুর তুলছেন তবলচি। দর্শকদের মধ্যে দারুণ উৎকণ্ঠা। দেসদিমোনার ভূমিকায় বাসন্তীর অভিনয় দেখে অন্যান্য নাট্যকর্মীরাও বিস্মিত। কি সুন্দর মুখের এক্সপ্রেশন বাসন্তীর। মরণ-যন্ত্রণার এত ভাল ছটফটানি কি সুজাতা করতে পারত?
নাটক প্রায় শেষ। পর্দা নামবে একটু পরে। মূল ‘ওথেলো’ নাটকে আরেকটু অংশ ছিল বটে, কিন্তু পরিচালক সাসপেন্স আনার জন্য তা ছেটে দিয়েছেন। কিসের সাসপেন্স? পরিচালক গৌতম বাবুর মুখে বিকট হাঁসি। ঠিক ওথেলোর মতোই। ইচ্ছে করলে সাত বছর আগেই তিনি ঝুঁকিটা নিতে পারতেন। কিন্তু তুষের আগুনের মতো তা পুষে রেখেছেন মনে মনে। মৃত্যুও একটা শিল্প। অসংখ্য মানুষের চোখের সামনে বাসন্তীর পরকীয়া প্রেমের শেষ পরিণতিটা আর্টিস্টিকেলি দেখাতে চেয়েছিলেন তিনি। হাজার-হোক, তিনিতো শিল্পী মানুষ। তখনও মৃত্যু যন্ত্রণায় হাত-পা ছুড়ছে দেসদিমোনা। অবশ্য, সে তখন আর দেসদিমোনা নয়, বাসন্তী। সুজাতা, বাগচি স্যার, ছাত্র-ছাত্রী, বৃদ্ধ, বিশেষ শ্রেণির লোকজন থেকে শুরু করে মহান নাট্যকার সেক্সপিয়রের ওথেলো নাটক উপভোগ করতে আসা অর্ধ-সহস্রাধিক দর্শকের সম্মুখে ওথেলোর ছদ্মবেশে গৌতম দেবনাথ দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করলেন। সকলের হাততালিতে মুখর হয়ে উঠল রামদাস প্রেক্ষাগৃহ।
No comments:
Post a Comment