Monday 10 September 2018

কেরালার করলা


কেরালার করলা
(বরুণ কুমার সাহা, গুয়াহাটি, ২৮/০৫/২০১৮)



রহমতের ঝাপ তোলা চায়ের দোকানে ঝড়ের বেগে ঢুকল ফারুক। তারপর সশব্দে পিঠ চাপড়ে উৎসাহের সঙ্গে খবর করলকি ভাই রহমত্ক্যামন চলতাছে?
আরে!! ফারুক ভাই দেহি! তাই-তো কই, এই গেরামে প্যান্‌-শাট পইর‍্যা ক্যারা আইতাছে আবার! তা অনেক দিন বাদে আইলা ভাই, কই ছিলা এতদিন? — বলতে বলতে বিড়ির প্যাকেটটা এগিয়ে দেয় রহমত।
নাক দিয়ে দু-তিনবার ধোঁয়া ছেড়ে অবশেষে ফারুক বলতে শুরু করেবিদ্যাশ বিদ্যাশ। ফরেন।
তাইতো এ্যাত্তো ফর্শা-ফর্শা লাগতাছে তোমারে। তা কোন্‌ বিদ্যাশ হুনি?
ক্যারালা
হায় আল্লা! নাম হুনি নাই কহনো...
হায়-রে রহমত! তগোরে কি কমু! তরা একটা মস্ত গাইম্যা ভূত। কুয়ার ব্যাঙ। ক্যারালার নাম হুনস নাই!!! ছিছিছি... চা আনাও চা আনাও চা আনাও...
রহমত হাক দেয়দে-রে, একপাপ চা দে, ইশপেশাল।
সঙ্গে একপ্লেট ভুজিয়া-বুন্দিয়াও আনিস্‌রেবলে বাক্য জোড়া দেয় ফারুক। তারপর আবার বলতে শুরু করে
তোমগোরে নিয়া যে কি করি! ক্যারালার নাম হুনো নাই! ক্যা, করলা খাও না, করলা? ইংলিশে উচ্ছে উচ্ছে, হিন্দিতে বেতার গাড।
বেতার গাড!
হ বেতার গাড। যেমন হোম গাড, তেমনি বেতার গাড। হোম গাড বাড়ি পাহারা দেয়, তেমনি বেতার গাড আমগো শরিল পাহারা দেয়। মানে অশুক-বিশুক থিকা রক্ষা করে। বেতারের বে মানে ব্যামার, আর তার মানে শিরা-উপশিরা।


ফারুকের জ্ঞানের বাহার দেখে রহমত বিস্মিত। নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে সে বলে
ভাইজান, আমি মুক্‌খু-সুক্‌খু মানুষ। গোল্লার সিরা বাদে অন্য শিরা-উপশিরা আজ পর্যন্ত দেহি নাই।
ফারুক একটু ভর্ৎসনার সুরেআরে বুর্বক, শিরা চেনোস না! খাওয়ার পর ভাত যেই দিক দিয়া প্যাটে যায়, হেইডারেই কয় শিরা, ইংলিসে ভেন।
রহমত আবার ছানাবড়া চোখ তুলে ফারুকের দিকে তাকায়। তারপর জিজ্ঞেস করে
তা ভাই, ক্যারালায় কি কইত্যে গেছিলা? করলার চাষ?
ফারুক একগাল হেসেক্যারা কয় রহমতের মাথায় বুদ্ধি নাই! এইতো তুমি ঠিক ধরসাও। আসলে করলার উৎপত্তি ওই ক্যালেরা দ্যাশেই। এ্যাতো চাষ হয়, এ্যাতো চাষ হয় যে, দ্যাশটার সাইজও ওই করলার মতো লম্বা হয়া গ্যাছেগা। হেইর লিগাইতো দ্যাশটার নাম ক্যারালা। আমি ওইহানে গ্যাছিলাম আসলে বিছন আনতে।
বলতে বলতে ফারুক উত্তেজিত হয়ে ওঠে, এবং ক্রিকেট খেলায় আম্পায়ার যেভাবে ওয়াইড বল দেখায়, ঠিক ততটাই হাত প্রশস্ত করে, নাকটা সাপের মতো ফুলিয়ে, নাটুকে চোখদুটো গোল গোল করে বলতে শুরু করে
কি কমু রহমত ভাই, এইসা বিশাল বিশাল করলা, দ্যাখতে আমগোরে কাঠালের মতো, কুমিরের পিঠ যেমন কাটা-কাটা-কাটা-কাটা থাকে, ওই রহম  চামড়া, আর কি মিইইইস্টি!!!
মিস্টি!! কি কও ভাইজান? করলা মিস্টি!!
ফারুক এবার একটু রেগেক্যা, কুসার কখনো পাইন্‌সা হয় না ? তরমুজ পাইন্সা হয় না ? আম টক হয় না ? তর দোকানে দই টক্‌ হয় না ?
একটু থেমেতাইলে করলা যদি মিষ্টি হয় তাতে সমস্যাডা কী?
হ হ, কোনো সমস্যা নাই। বরং ভালই হব। মাঝে-মইধ্যে কাঠালের বদলে করলার রস চিপ্পা হুরুম দিয়া খামু।
আরে, ওই দ্যাশের মানুষতো তাই খায়। তাইর লিগাইতো অগো শরিলের কি গেলেজ! আর হেইরলিগাই অগো ভেন সেই শক্ত। তাই বেরেনো ভালো। ভেন আর বেরেন, মিল আছে না?
রহমত অস্বাভাবিকভাবে মাথা ঝাঁকি দিয়ে সম্মতি জানায়।


ফারুক এবার কথার ছলে খবরের কাগজ দিয়ে ঢাকা গোল্লার গামলাটা ফাঁক করে দেখে, এবং তৎক্ষণাৎ মুখমণ্ডলে বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব ফুটিয়ে বলতে শুরু করেকিন্তু ওই দ্যাশের মাইন্সেরা হুরুম্‌রে হুরুম্‌ কয় না, কয় মুড়ি।
রহমত কপাল চাপড়াতে শুরু করেআল্লা গো! আমরা কোন দ্যাশে পইর‍্যা রইছি, দুনিয়ার কিছছু জানি না!
তারপর নিজেকে একটু সামলে নিয়েতা ভাই কদ্দুর তোমার ওই ক্যারালা দ্যাশ হুনি?
প্লেট থেকে পড়ে যাওয়া শেষ বুন্দিটায়া মুখে পুরে ফারুক আবার শুরু করল
দূরের কথা আর কইয়ো না। এইহান থিকা চান্দ যতদূর, তার থিকাও মনে করো আরো পাঁচগুণ। আর যে ব্যাকাতেরা রাস্তা! পাহাড়-পর্বত পার হয়া, বন-জঙ্গল পার হয়া, সাত নদি তেরো সমুদ্দর পার হয়া, আগ্নেয়গিরি পার হয়া, বরফের দ্যাশ পার হয়া, ছিলঙ্কা-জাপান-আজ্জেন্টিনা-ইটালি-ব্যালজিয়াম পার হয়া এহ্যেবারে শ্যাষে ক্যারালা।
রহমতের হা করা মুখের সুযোগ নিয়ে ফারুক হাক দেয়

দে-রে, দুইড্যা রসগোল্লা আন।
রহমতের দোকানদারিতে মন নেই, সে শুধু ফারুকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে প্রশ্ন করতে ব্যস্ত
এ্যাত্তো দ্যাশের নাম তোমার মনে থাকে কেবা কইর‍্যা ফারুক ভাই!!
ক্যা, মনে থাকব না ক্যা... ওই দ্যাশগুলায় কত্ত গেছি। গলিয়ে গলিয়ে চিনি। ব্যালজিয়ামের মানুষগুলারে দ্যাইখ্‌লে কি কবা! সাদা ধবধবা, আর মাথায় পাগড়ি, আমগোরে পাঞ্জাবিগো মতো।
ক্যা?
ক্যা আবার! ওই দ্যাশে অলিয়ে গলিয়ে খালি ব্যাল গাছ। রাস্তাঘাটে ব্যাল পইরা যাতে মাথা না ফাটে, তাই পাগড়ি পরা নিয়ম। নাইলে ফাইন। অই জন্যই দ্যাশটার নাম ব্যালজিয়াম।

   আচ্ছা, বুজলাম ব্যালজিয়ামের ব্যাল মানে ব্যাল, আর জিয়াম মানে?

  জি মানে জিন্দেগি, আর আম মানে আম । অগো দ্যাশে জিন্দেগিতে আম ধরে না, তাই জিয়াম। ব্যালজিয়াম।

বলেই রসগোল্লাদুটো ঘপাঘপ গিলে আবার বলতে শুরু করেতেমনি জাপানের পান, আজ্জেটিনার টিন, ইটালির টালি, হাঙ্গারির গাড়ি, ছিলঙ্কার মরিচ, ইংরাজিতে যারে কয় চিলি, এগুলা জগতে ফ্যামাস, মানে বিক্‌খাতো।
হ ভাই, আইজ তোমার কাছ থিকা কত কিছু যে জাইনতে পাইরলাম। মাঝে সময়ে দেহ্যা দিবা কইলাম।
নারে ভাই রহমত, সময়ের টানাটানি। দুইদিনের জইন্য আইছি, তাতেও শান্তি নাই। খালি মিনিস্টারের ফোন ফোন আর ফোন।

তা এহন আমি উঠি ভাই, সইন্ধায় মিটিং আছে একটা। যাইএই বলে ফারুক উঠে দাঁড়াল।


রহমত এতক্ষণ পৃথিবী পরিভ্রমণেই মগ্ন ছিল। হুঁশ ফিরে পেয়েই নিজের আসল সত্তায় ফিরে এল সে। তারপর লাজ-শরম-সংকোচ পরিত্যাগ করে হিসেব কষতে লাগলচা পাঁচ ট্যাহা, ভুজিয়া-বুন্দিয়া দশ ট্যাহা, নিমকি পাঁচ ট্যাহা, দুইড্যা গোল্লা বিশ... সব মিলায়া চল্লিশ ট্যাহা।


ফারুক দুই কদম পিছিয়ে এল। জলের মগ শূন্যে তুলে ঢগঢগ করে জল গিলল। তারপর শরীরের সমস্ত পকেট তন্ন তন্ন করে খুঁজে অবশেষে নিরাশ মনে জবাব দিলনা ভাই, মনে হইতাছে চেক-বইটা ঘরের ফ্যালায়া আইছি। আইজ কাইল ক্যাশ নিয়া ঘুরি না... রিক্‌স... তা তুমি লেইহ্যা রাহো... আমি কারো হাতে পাঠায়া দিমুনি।


গোমর বুঝতে পেরে রহমত পুরনো খাতা বের করে। তারপর হিসেব কষেআগেরবারও তুমি বাকি খায়া পয়সা দেও নাই। আগের বিরানব্বই, আর এহনের চল্লিশ...
এবার ফারুক খেপে যায়ক্যারা কয় আমি আগের পয়সা দেই নাই?
— কবে দিলা?— বলে রহমত আকাশ থেকে পড়ে।
ক্যান, তর একাউন্টে পাঠায়া দেই নাই? চেক করস নাই ব্যাঙ্ক খাতা?
কোন ব্যাঙ্ক! আর আমার খাতার নাম্বারইবা তুমি পাইলা কই?
এবার ফারুক বুকটা ফুলিয়েহা হা হা... ওগলা আমার বাম হাতের খেলা... ইন্টারলেট থিকা ডাউললোড করছি।
রহমততা ফারুক ভাই, আমার তো কোনো ব্যাঙ্ক খাতা নাই... ডাউললোড করলা ক্যামনে?’
এবার ফারুক শাসনের সুরেওরে গাইম্যা ভূত... কিছুই জানস না... সরকার যে সবাইরে ব্যাঙ্ক খাতা খুইল্যা দিছে... কিছুই জানো না! দ্যাহোগা কত পয়সাবান জমছে!
রহমত চোখদুটো বিস্ফারিত করেকী কও!!!

ফারুকহ। আইজ শনিবার, সোমবারে ব্যাঙ্কে গিয়া খবর কইরো। ওইহানেই আমার চল্লিশ ট্যাহাডা পাঠায়া দিমুনি।

বলতে বলতে ফারুক গটগট করে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে।


রহমত হাঁ করে তাকিয়ে রইল। তারপর কৃতজ্ঞতা চিত্তে পেছন থেকে ফারুককে হাঁক দিলভাইজান আবার আইসো... আর হ, এইবার ক্যারালায় গেলে আমার জইন্যে করলার বিছন আনতে ভুইল না কিন্তু...

No comments:

Post a Comment